মার্কিন রিটেইলারদের দিকে দৃষ্টি: অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংকেত খুঁজছেন বিনিয়োগকারীরা
আসন্ন সপ্তাহে ওয়াল স্ট্রিটের ট্রেডারদের দৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম রিটেইল চেইনগুলোর আয় প্রতিবেদনগুলোর দিকে থাকবে—যেগুলো থেকে বোঝা যাবে বাণিজ্য পরিস্থিতির পরিবর্তন অর্থনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলছে এবং স্টক মার্কেটের সাম্প্রতিক ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা কতটা টেকসই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে।
বাণিজ্য যুদ্ধের বিরতিতে স্বস্তি ফিরেছে, কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে
টার্গেট্, লোই'স এবং হোম ডিপোর মতো রিটেইল জায়ান্টগুলো এই সপ্তাহে তাদের প্রান্তিকভিত্তিক আয়ের প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে যে মন্দার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধবিরতি সেটি খানিকটা প্রশমিত করেছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন করে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে।
ওয়ালমার্টের সতর্কতা: মূল্যবৃদ্ধির জন্য প্রস্তুত থাকুন
তবে বৃহস্পতিবার ওয়ালমার্টের এক বিবৃতি মার্কেটে আবারও উদ্বেগ ছড়িয়ে দেয়। বিশ্বের বৃহত্তম রিটেইল প্রতিষ্ঠানটি জানায়, বাড়তি শুল্কের কারণে তাদের পণ্যের দাম বাড়াতে হতে পারে। এতে বিনিয়োগকারীরা অন্যান্য রিটেইলারদের আয়ের প্রতিবেদন খতিয়ে দেখতে শুরু করেছেন—তারা কীভাবে এই অনিশ্চিত বাণিজ্য পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, এবং এটি তাদের লাভ এবং কৌশলগত পরিকল্পনাকে কীভাবে প্রভাবিত করছে।
শুল্ক: অনিশ্চয়তার প্রধান কারণ
নতুন করে শুল্ক আরোপের আশঙ্কায় মার্কেট এখনো চাপের মধ্যে রয়েছে। এগুলো একদিকে যেমন পণ্যের দাম বাড়াবে, তেমনি কমিয়ে দিতে পারে ভোক্তাদের ব্যয়ের প্রবণতা—যা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। ২ এপ্রিল "লিবারেশন ডে" উপলক্ষে ট্রাম্পের নতুন শুল্ক ঘোষণার পর এই উদ্বেগ আরও তীব্র হয়েছে।
ভোক্তা: অর্থনীতির মূল নির্দেশক
রিটেইল কোম্পানিগুলোর আয়ের প্রতিবেদনগুলো বর্তমান মার্কিন ভোক্তাদের আচরণ বুঝতে সহায়তা করতে পারে—যাদের ব্যয় দেশটির মোট জিডিপির দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি। তারা কি এখনো খরচ করছে, না কি সঞ্চয়ের দিকে ঝুঁকছে, সেটিই নির্ধারণ করবে এই অস্থির ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অর্থনীতি কতটা স্থিতিশীল থাকবে।
খুচরা বিক্রয়ে ধীরগতি
সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, আমেরিকানরা এখন ব্যয় নিয়ে আরও সতর্ক। এপ্রিল মাসে খুচরা বিক্রয়ের প্রবৃদ্ধি স্পষ্টভাবে কমে গেছে। শুল্কের ভয়ে আগেভাগে পণ্য মজুদ করে রাখার প্রবণতা হ্রাস পাওয়াই এই মন্থরতার অন্যতম কারণ। একই সঙ্গে, সাম্প্রতিক জরিপগুলোতেও দেখা গিয়েছে, ভোক্তাদের আস্থাও তুলনামূলকভাবে দুর্বল হয়ে।
রিটেইল সেক্টরের অবস্থা: বিলাসবহুল ব্র্যান্ড থেকে ডিসকাউন্ট
আরও কিছু আয়ের প্রতিবেদন আসছে সামনে: সুপরিচিত ফ্যাশন ব্র্যান্ড র্যালপ লরেন এবং ডিসকাউন্ট চেইন টিজেএক্স কোম্পানিজ (যারা টিজে ম্যাক্স ও অনুরূপ ব্র্যান্ডের মালিক) তাদের আয় প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। এই প্রতিবেদনগুলোর ফলাফল থেকে বোঝা যাবে, ভোক্তা কাহতের অবস্থা কেমন—ব্র্যান্ডপ্রেমী ক্রেতা থেকে শুরু করে ডিসকাউন্ট খোঁজার ক্রেতা পর্যন্ত। বিনিয়োগকারীরা পুরো চিত্র জানতে চায়: মার্কেটে এই অস্থিরতার মধ্যে কারা হারাচ্ছে এবং কারা জিতছে।
ওয়াল স্ট্রিট ঘুরে দাঁড়াচ্ছে: মার্কেটে ফিরে এলো প্রাণ
২ এপ্রিল ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক মন্তব্যের পর মার্কেটে ব্যাপক দরপতন ঘটলেও এরপর মার্কেট আশ্চর্যজনকভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। S&P 500 সূচক এপ্রিলের সর্বনিম্ন লেভেল থেকে ১৮%-এর বেশি বেড়েছে, যা বছরের শুরু থেকে সমস্ত ক্ষতি পূরণ করে ফেলেছে। এই পুনরুদ্ধার একটি পরীক্ষাস্বরূপ: মার্কিন অর্থনীতি কি সত্যিই সামনে এগোতে প্রস্তুত, না কি এটি কেবল রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির জোড়ে তাত্ক্ষণিক গতি?
চীন থেকে সতর্কবার্তা: পূর্ব দিকের সংকেত
মার্কিন আশাবাদের মধ্যে এশিয়া থেকে এসেছে দুশ্চিন্তার খবর। চীনের খুচরা বিক্রয় অপ্রত্যাশিতভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি থেকে অভ্যন্তরীণ ভোক্তা নির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরের কষ্ট প্রতিফলিত করছে। এটি শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়—এটি এক সতর্কবার্তা যে চীন এখনও বৈশ্বিক ভোক্তা শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য প্রস্তুত নয়, ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্যিক খাত এখনো ঝুঁকিতে রয়েছে।
হাতে খুব বেশি কার্ড নেই: ট্রাম্প অগ্রাধিকার পুনর্নির্ধারণ করছেন
নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই ট্রাম্প আমেরিকানদের সতর্ক করেছেন যে সস্তা আমদানিকৃত পণ্যের যুগ শেষ হতে চলেছে। "কমদামি পুতুল আর পেন্সিলের দিন শেষ", এটি কেবল একটি রূপক নয়—এটি দিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতি কেবল চীনের উপর চাপ প্রয়োগে সীমাবদ্ধ নয়, বরং দেশটির ভোক্তা আচরণ নতুনভাবে গঠনের দিকে মনোযোগী। পাশাপাশি, ট্রাম্প চান চীন যেন আরও বেশি মার্কিন পণ্য কেনে।
আমেরিকার পছন্দ: ন্যায্য চুক্তি না হলে শুল্ক
মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি বিদেশি অংশীদারদের তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, তাদের "ন্যায্য নিয়ম" মেনে চলতে হবে, না হলে আরও বেশি শুল্কের মুখোমুখি হতে হবে। তিনি আরও জানান, হোয়াইট হাউসের নজরে আছে কেবল ১৮টি মূল দেশ—বাকিদের জায়গা পাওয়ার জন্য লড়তে হবে, না হলে তারা ছিটকে পড়বে।
নতুন শুল্ক সীমা: আইন ছাড়াই কর আরোপ
যুক্তরাষ্ট্রে কার্যকর আমদানি শুল্ক এখন ১৩%-এ পৌঁছেছে—যা গ্রেট ডিপ্রেশনের পর সর্বোচ্চ। কার্যত এটি একটি "গোপন কর" হিসেবে কাজ করছে, যা জিডিপির ১.২%-এর সমতুল্য। হোয়াইট হাউস আশা করছে ওয়ালমার্টের মতো জায়ান্টরা এই খরচ নিজে বহন করবে, কিন্তু কতোদিন তা টিকবে, সেটি এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ।
শুল্ক এখন প্রতিশ্রুতির অর্থায়নের হাতিয়ার
ট্রাম্প প্রশাসন এখন শুল্ককে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ রাজস্বের উৎস হিসেবে দেখছে। এর অন্যতম লক্ষ্য হলো সদ্য প্রতিনিধি পরিষদে অগ্রসর হওয়া বিশাল শুল্ক ছাড়ের প্যাকেজ অর্থায়ন করা।
প্রতিশ্রুতির মূল্য: দশ বছরে $৫ ট্রিলিয়ন পর্যন্ত ঋণ
প্রেসিডেন্টের এই কর হ্রাস প্রকল্প অত্যন্ত ব্যয়বহুল হবে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। আগামী এক দশকে এটি জাতীয় ঋণ $৩ থেকে $৫ ট্রিলিয়ন পর্যন্ত বাড়াতে পারে। এই রকম ঘাটতির বিস্তার নজর এড়ায়নি: মুডি'স যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেডিট রেটিং একধাপ কমিয়ে দিয়েছে, যা মার্কেটে উদ্বেগের বার্তা পাঠিয়েছে।
আস্থায় চিড়: বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা অস্বস্তিতে
এই বিষয়গুলো বিশ্ববাজারের বিনিয়োগকারীদের নজর এড়ায়নি। ওয়াশিংটনের বিশৃঙ্খল এবং অনিশ্চিত নীতির কারণে ইতোমধ্যেই সতর্ক বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। সোমবার সকালে, প্রধান ওয়াল স্ট্রিট সূচকের ফিউচার ১%-এর বেশি কমে গেছে—যা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকির প্রতি উদ্বেগের স্পষ্ট সংকেত।
বন্ড ও ডলারের অদ্ভুত আচরণ: সমন্বয়হীন মুভমেন্ট
যখন স্টক মার্কেট দরপতনের শিকার হচ্ছিল, তখন ১০-বছরের ট্রেজারি বন্ডের ইয়েল্ড প্রায় পাঁচ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে যায়—যা মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার প্রত্যাশা বৃদ্ধি এবং আর্থিক নীতিমালার কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। মার্কিন ডলারও প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, যদিও তা সামান্য; যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক অবস্থার স্থায়িত্ব নিয়ে আস্থার ঘাটতির কারণে ডলার সামান্য দুর্বল হয়েছে।